শিকলে বেঁধে চুল কেটে- কথায় বলে- পুরুষ মানুষ দুই প্রকার। জীবিত আর বিবাহিত। সত্যিই কি বিয়ের পর পুরুষের সুখ চলে যায়? তাদের মন কি বিষিয়ে ওঠে? নাকি অন্য কিছু? এমন প্রশ্ন হয়তো ঘুরপাক খাচ্ছে যারা ব্যাচেলর তাদের মনে। হয়তো কেউ কেউ বলছেন, বর্তমানে দেশে যেভাবে পরকীয়ার উপদ্রব না জানি বিয়ের পর ‘বউ’ কি করে? আবার অনেক ছেলে বিয়ে না করার চিন্তা করে বসে থাকে! তখন পরিবারের লোকেরা জোর করে তার বিয়ে দিয়ে দেয়।
ভাবছেন এসব কথা কেন বলছি? কারণ, বিয়ে হল একটা পবিত্র বাঁধন। কিন্তু আমরা কি করছি? বিয়ের পর পরকীয়া! নয়তো যৌতুকের জন্য বউকে নির্যাতন অথবা জোর করে বিয়ে দিয়ে সংসারে অশান্তি।
আপনাদের আজকে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় এলাকার একটি গল্প বলবো। যেখানে এক গৃহবধূর ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালিয়েছে তার স্বামী। নিজের স্ত্রীকে অর্ধউলঙ্গ করে কোমরে শিকল বেঁধে টানা চার দিন অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। এমনকি মারধর শেষে স্বামীর প্রস্রাব জোর করে পান করাতে বাধ্য করা হয়েছে তাকে। চিৎকার করতে গেলে তার মাথার চুল কেটে দেয়া হয়েছে।
অবাক হচ্ছেন তাই না! অবাক হলেও এমনই ঘটনা ঘটেছে সেই এলাকায়। গৃহবধূটির নাম তাহেরা আক্তার রিনা (২৪)। গত রবিবার (৮ জুলাই) সন্ধ্যায় উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের উত্তর হরিপুর গ্রামে স্বামীর বাড়ি থেকে কোমরে শিকল বাঁধা অবস্থায় তাহেরা আক্তার রিনাকে উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিন রাত ১০টার দিকে নির্যাতনকারী স্বামী মঞ্জুর আলম বাদল হাজারিকেও (৪৫) ওই এলাকা থেকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল হায়দার চৌধুরী জুয়েল। পরে রাতে ওই গৃহবধূ বাদী হয়ে ছাগলনাইয়া থানায় মামলা করেন। পরে সোমবার ফেনীর আদালতে পাঠানো হয় তাকে। মঞ্জুর উত্তর হরিপুর গ্রামের মৃত নজির আহমদ হাজারির ছেলে। আর নির্যাতনের শিকার তাহেরা আক্তার রিনা ফেনী সদরের কাতালিয়া গ্রামের মৃত আমিনুল এহসান ওরফে বাবুল ডাক্তারের মেয়ে।
ভুক্তভোগী গৃহবধূ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বিয়ের জন্য বাদলকে যেদিন তাকে প্রথম দেখানো হয় সেদিন তার পছন্দ হয়নি। এক পর্যায়ে তাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। আর এই অমানুষিক নির্যাতনের পেছনে তার মা এবং ভাইয়ের হাত রয়েছে বলেও দাবি করে রিনা।’
মামলার এজাহারে রিনা জানিয়েছে, ২০১৭ সালে ২৩ মার্চ তার মা বিবি ফাতেমা এবং ভাই রেজাউল করিম রাজু কাউকে না জানিয়ে সামাজিকভাবে ফেনীর লস্করহাট এলাকায় তার ফুফাতো বোনের স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে মঞ্জুরের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া হয়।
বিয়ের পর রিনা জানতে পারে, মঞ্জুর এর আগেও দুই বিয়ে করেছেন এবং তার দুটি সন্তানও রয়েছে। এরপর থেকেই বিভিন্ন কারণে তার ওপর নির্যাতন শুরু হয়।
তবে রিনারও ২০১৪ সালে চৌদ্দগ্রামে কামাল নামে এক মৌলভীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তখন সে দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। বনিবনা না হওয়ায় এক বছরের মাথায় তাদের বিয়েবিচ্ছেদ হয়। মঞ্জুরের সঙ্গে বিয়ের পর কয়েক দফা সালিশ বৈঠক হলেও কোনো তার কোন পরিবর্তন হয়নি।
অবশেষে নির্যাতন সইতে না পেরে গত বছরের অক্টোবর মাসে কৌশলে স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা কেরানিগঞ্জ চলে যান রিনা। প্রায় ৯ মাস পর গত ৫ জুলাই দুপুরে চৌদ্দগ্রামের চিউড়া এলাকার নানার বাড়িতে ফেরেন রিনা।
এ খবর পেয়ে ওইদিন বিকালে ওই বাড়িতে হাজির হন তার, মা, ভাই এবং স্বামী। ওইদিন সন্ধ্যায় তারা তার হাত পা বেঁধে মাইক্রোতে করে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যান। তার মা, ভাই চলে যাওয়ার পর স্বামী বাদল হাজারি তার কোমরে শিকলের একাংশ বেঁধে অপর অংশ জানালার সঙ্গে তালা লাগিয়ে দেয়।
রিনা এজাহারে আরও অভিযোগ করেন, বাদল হাজারি ওই রাতেই প্রস্রাব করে বোতলে ভরে তাকে (রিনা) জোর করে খাইয়ে দিয়েছেন এবং মাথার চুল কাচি দিয়ে কেটে দিয়েছেন। তাকে তক্তা দিয়ে সারা শরীরে আঘাত করেছেন। নির্যাতনের সময় চিৎকার করলে বাদলের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি।
পরে গোপনে খবর পেয়ে এসআই নাইমের নেতৃত্বে রিনাকে উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে বাদল হাজারির বাড়ির লোকজন জানান, তার অত্যাচারে আগের দুই বউ তাকে তালাক দিয়েছে। দুই সংসারে দুটি সন্তান রয়েছে। এ সংসারে কোনো সন্তান নেই। এ বউয়ের ভাই এবং মা তার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। যার কারণে মেয়ের প্রতি তাদের দরদ নেই। বাদলের বদমেজাজির কারণে বাড়ির লোকজন কেউ শান্তিতে নেই।
এ ব্যাপারে পাঠাননগর ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল হায়দার জুয়েল বলেন, ‘খবর পেয়ে বাদলকে আটক করে পুলিশে দিয়েছি। স্বামী ও স্ত্রী দু’জনের মধ্যেই দোষ রয়েছে।’
ছাগলনাইয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুদ্বীপ রায় পলাশ জানান, ভিকটিমকে ( তাহেরা আক্তার রিনা) সেফহোমে পাঠানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তার মা এবং একমাত্র ভাইকে খবর দেয়ার পরও তাকে নিয়ে যেতে তারা থানায় আসেনি।
ছাগলনাইয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমএম মুর্শেদ জানান, ‘গোপন সংবাদে অভিযান চালিয়ে গৃহবধূকে উদ্ধার করা হয়। থানায় এনে কোমর থেকে কেটে তার শিকল খোলা হয়েছে। সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।’
তিনি আরও জানান, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ওই গৃহবধূর স্বামী বাদল হাজারিকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।